কুলাউড়ার বরমচালে দুর্ঘটনাকবলিত আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস : সংগৃহীত
মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার বরমচাল রেলস্টেশনের অদূরে ব্রিজের স্লিপার ভেঙে সিলেট থেকে ছেড়ে আসা আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস রোববার রাত সাড়ে ১১টায় ভয়াবহ দুর্ঘটনায় পড়ে। এতে চার যাত্রী নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছেন। লাইনচ্যুত হয়ে ট্রেনের তিনটি বগি খালে পড়ার পর ঘটনাস্থলে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এলাকাবাসীর পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিট, স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীসহ পুলিশ, বিজিবি, রেল পুলিশ ও জেলা প্রশাসন উদ্ধার কাজ চালিয়ে যায়। রাতে হতাহতদের উদ্ধারের পর গতকাল সোমবার সকাল থেকে চলে রেললাইন মেরামতের কাজ।
এদিকে ট্রেন দুর্ঘটনার কারণ জানতে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে আঞ্চলিকপর্যায়ের শীর্ষ চার কর্মকর্তাকে নিয়ে। আর বিভাগীয়পর্যায়ের কমিটিতে সদস্য পাঁচজন। দুটি কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। গতকাল সোমবার এই দুটি কমিটি গঠনের কথা জানান বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক কাজী মো: রফিকুল আলম। আঞ্চলিক শীর্ষ চার সদস্যের তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক হলেন রেলওয়ের চিফ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার (পূর্বাঞ্চল) মো: মিজানুর রহমান। অন্য তিন সদস্য হলেন প্রধান প্রকৌশলী (পূর্ব) আবদুল জলিল, চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট (সিওপিএস) সুজিতকুমার এবং চিফ সিগন্যাল অ্যান্ড টেলিকম অফিসার (পূর্ব) ময়নুল ইসলাম। বিভাগীয় কর্মকর্তাপর্যায়ের কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে ডিটিও (কমলাপুর, ঢাকা) মো: ময়নুল ইসলাম। পাঁচ সদস্যের কমিটির সদস্যরা হলেন ডিএমই (পূর্ব, চট্টগ্রাম) শাহ সুফি নূর মোহাম্মদ, ডিএমও (কমলাপুর, ঢাকা) আবদুল আহাদ, ডিএসটিই (কমলাপুর, ঢাকা) আবু হেনা মোস্তফা আলম এবং ডিইএন-২ (ঢাকা) আহসান জাবির।
অন্যদিকে গতকাল সকাল সাড়ে ৯টায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন রেলওয়ে সচিব মোফাজ্জল হোসেন। তিনি জানান, রেল ব্রিজটি ভেঙে গেছে ও লাইন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব মেরামত না করা পর্যন্ত চট্টগ্রাম ও ঢাকার ট্রেনগুলো আপাতত কুলাউড়া পর্যন্ত চলাচল করবে। তিনি আরো জানান, বগি উদ্ধারের পর লাইন ও সেতু মেরামতে কমপক্ষে পাঁচ-ছয় দিন সময় লাগতে পারে। আশা করা হচ্ছে পাঁচ-ছয় দিনের মধ্যে সিলেটের সাথে সারা দেশের ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক করা সম্ভব হবে। তিনি জানান, এ পর্যন্ত চারটি লাশ উদ্ধার হয়েছে এবং আহতের হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে।
ট্রেনের তিন বগি লাইনচুুত হয়ে নিহত চারজনের নাম পরিচয় নিশ্চিত করেছেন কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারপরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার নুরুল হক। নিহতরা হলেন কুলাউড়া উপজেলার আব্দুল বারির স্ত্রী মনোয়ারা পারভীন (৪৫), সিলেট নার্সিং কলেজের ছাত্রী সিলেট সদরের আব্দুল্লাপুরের আব্দুল বারির মেয়ে ফাহমিদা ইয়াসমিন ইভা (২০), একই প্রতিষ্ঠানের ছাত্রী বাগেরহাট জেলার মোল্লারহাট উপজেলার আকরাম মোল্লার মেয়ে সানজিদা আক্তার (২০) ও হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার নুর হোসেনের ছেলে কাওছার হোসেন (২৬)।
এদিকে বরমচালে উপবন দুর্ঘটনার পর কুলাউড়া থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রাম রুটে আবার ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। গতকাল দুপুর ১২টায় জয়ন্তিকা ট্রেন ঢাকার উদ্দেশে কুলাউড়া থেকে ছেড়ে যায়। এর পর ৭১০ পাহাড়িকা চট্টগ্রামের উদ্দেশে এবং বিকেল ৪টায় আন্তঃনগর ৭১০ পারাবত এক্সপ্রেস ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায় বলে কুলাউড়া স্টেশন মাস্টার মুহিবুল ইসলাম নিশ্চিত করেছেন।
সিলেট-আখাউড়া রেলপথের শমশেরনগর স্টেশন সূত্রে জানা গেছে, রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকাগামী আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস বরমচাল স্টেশন অতিক্রম করে কুলাউড়া আসার পথে একটি কালভার্ট ভেঙে পেছনের তিনটি যাত্রীবাহী বগি খালে পড়ে যায়। ঘটনার পর থেকে সিলেটের সাথে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
অতিরিক্ত জেলা পুলিশ সুপার রাশেদুল ইসলাম জানানদুধুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত চারজন নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনজন নারী, বাকি একজন পুরুষ। নিহতদের স্বজনরা হাসপাতালের মর্গ থেকে শনাক্ত করে লাশ নিয়ে গেছে। তিনি বলেন, এ ঘটনায় শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। কুলাউড়া ছাড়াও মৌলভীবাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিকে আহতদের ভর্তি করা হয়েছে।
সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল হাসপাতালে যাত্রী ফয়ছল আলী (২৫) জানান, বিকট শব্দে প্রথমে আতঙ্কিত হয়ে অনেকে থতমত খেয়ে যায়। প্রথমে তারা বুঝতে পারেনি। অনেক সময় আটকে থাকার পর রেল থেকে নেমে দেখতে পান প্রচুর লোকজন। দেখতে পান পেছনের দিকের তিনটি বগি লাইনচুুত হয়ে গেছে। তখন অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিসও আসে। তারা তখন বুঝতে পারেন বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। তিনি আরো জানান, গত কয়েক দিন যাবত ঢাকার সাথে সরাসরি বাস যোগাযোগ বন্ধ থাকায় ট্রেনে যাত্রীর সংখ্যা বেশি ছিল।
রাতেই কুলাউড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আহতদের দেখতে আসেন মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মো: তোফায়েল ইসলাম, পুলিশ সুপার মো: শাহজালালসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
ঘটনাস্থলে গেলে কথা হয় এলাকার রফিকুল ইসলাম, সুন্দর মিয়া ও আলাউদ্দিন আহমদসহ বেশ কয়েকজনের সাথে। তারা জানান, ট্রেনটি সাধারণ গতির চেয়ে অনেক দ্রুত গতিতে চলছিল। দ্রুত গতিতে ট্রেন চলার কারণে দুর্ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। তা ছাড়া ১৭টি বগি নিয়ে ট্রেনটি চলছিল। বরমচাল স্টেশনের সহকারী মাস্টার জানান, ট্রেনটি বরমচাল স্টেশন পার হওয়ার দুই-তিন মিনিটের মধ্যে দুর্ঘটনার শিকার হয়। প্রথমে ট্রেনের একেবারের পেছনের বগি লাইনচ্যুত হয় এবং এর পরপরই তিনটি বগি উল্টে পড়ে ব্রিজ ভেঙে খালে পড়ে। এলাকাবাসীর মতে, নদীতে পানি কম থাকায় হতাহতের সংখ্যা কম হয়েছে। তবে আহতদের অনেকের অবস্থা খুবই খারাপ বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন।
২২ ঘণ্টা পর সিলেটের সাথে ট্রেন চলাচল শুরু : এ দিকে কুলাউড়ার বরমচালে দুর্ঘটনার ২২ ঘণ্টা পর গতকাল রাত ৯ টা ২৫ মিনিটের সময় সিলেট রুটে ট্রেন চলাচল চালু করা হয়েছে। ওই সময় সিলেট স্টেশন থেকে চট্টগ্রামগামী আন্তঃনগর উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনটি যাত্রা করে। রাত ১০টা ২৫ মিনিট নাগাদ দুর্ঘনাকবলিত বরমচাল রেলব্রিজ এলাকা অতিক্রম করে।
বরমচাল স্টেশনের সহকারী স্টেশন মাস্টার রুমান আহমদ রাত সাড়ে ১০টায় নয়া দিগন্তকে জানান, সিলেট থেকে ছেড়ে এসেছে চট্টগ্রামগামী উদয়ন ট্রেন। ট্রেনটি বরমচাল দুর্ঘটনা এলাকায় থামে। এরপর রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট দায়িত্ববানরা মেরামতকৃত ব্রিজ ও লাইন পরীক্ষা শেষে ৫ মাইল বেগে ধীরে ধীরে ট্রেন চালানো হয়েছে ব্রিজ ও লাইনের উপর দিয়ে। এর আগে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় পরীক্ষামূলকভাবে একটি রিলিফ ট্রেন ব্রিজ ও মেরামতকৃত লাইনের উপর দিয়ে চালনো হয়। সফলভাবে ট্রেন চালানোর পর নিয়মিতভাবে ট্রেন চলাচলের সিদ্বান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ।
Leave a Reply